অসমাপ্ত ভালোবাসা…..

চিরকুমার মুজিবর কোনদিন ভাবেনি তাকে ষাট বছর বয়সে এসে বিয়ে করতে হবে। তাও আবার নাত-বউ কে। অন্যদিকে তালাক দেওয়া স্বামীর চাওয়ার কাছে হার মানতে হলো আছিয়াকেও। গ্রামের বিশিষ্ট আলেম মাওলানা হাফিজুরের পরামর্শ মতো বউকে মুজিবর নানার সাথে বিয়ে দিল কিসমত আলী। বাসর ঘর সাজানো ছাড়া সব আয়োজনই ছিলো। গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবাই যেন বহুদিন পর উৎসবের আমেজে ভাসলো। কলা পাতায় পেট ভরে খিচুড়ী খেল সবাই।

তালাক দেওয়া বউকে আবার ঘরে তুলতে না পারলে গলায় দড়ি দেবে কিসমত। বাধ্য হয়ে গত সোমবার গ্রামের বিশিষ্টজনদের নিয়ে আদাবর মোড়লের বাড়ীতে বৈঠক বসে। সেখানেই মাওলানা হাফিজুর সবাইকে বলেন, ‘তালাক দেওয়া বউকে পুনরায় বিবাহ করিতে হইলে আছিয়াকে চার মাসের জন্য অন্য কাহারো সহিত বিবাহ দিতে হইবে। সেইখানে আবারো তালাক ঘটাইয়া চার মাস পর পুনরায় বিবাহ করিতে পারিবে কিসমত। ইসলামে ইহাকে বলে ‘হিল্লা বিয়ে’। এছাড়া কোনমতেই আছিয়ার সহিত কিসমতের বিবাহ সম্ভব না।’

পাতলা গড়নের মায়া ভরা মুখ মুজিবরের। বিয়ে না করায় নিজের কোন নাতী-নাতনী নেই । তবে ভাইয়ের নাতী-নাতনী বা পুতা-পুতনীদের জান দিয়ে ভালোবাসেন। অন্যদিকে মুজিবর তার নানার ভাই হলেও নিজের আপন নানার মতই দেখে কিসমত। তাই কিসমতের এই দুর্দিনে ‘না’ করতে পারল না মুজিবর। তবে বেঠকে কী মনে করে তিনি এক শর্ত জুড়ে দিলেন।

-বিয়েডা কিন্তু ধুমধাম কইরা হইতে হবে
– ক্যান নানা, তার আবার কী দরকার? তুমি শুধু নামেমাত্র আমার বউডারে বিয়ে কইরবা। এতো সবের কী দরকার!
-তুই বুজবিনে। বিয়া যহন করতেছি, সংসার করি না করি বিয়ার আনন্দ তো করতে দিবি।

একটা গুনজন শুরু হলো। কেউ একজন বললো, ‘এই বুড়োর মতলব বালো না। কিসমত তুই অন্য কারো সাতে বিয়ে দে’। কিন্তু কিসমতের কথা, আপনজনের সাতে না দিয়ে পরের সাথে বিয়া দিলি যদি ওই বেটা পরে নিজের ইচ্ছেয় তালাক না দেয়?’ সবশেষে মুজিবরের সাথেই শুক্রবার বিয়ে ঠিক হলো। কিসমতের মতামত নিয়ে কেবল বাসর ঘর সাজানো বাদে সব আয়োজনই হইলো।

আছিয়ার মতামত কেউ জানতে চাইল না। ভাসা ভাসা চোখ আর লম্বাটে নাক তার। গায়ের রং ফর্সা হওয়ার গ্রামের মানুষ তাকে রাঙ্গা ভাবী বলে ডাকে। বয়স একুশ-বাইশ হবে। আছিয়ার মা মারা গেছে তিন বছর আগে। বাবা আছে। সারাদিন ভ্যান চালিয়ে তিন মেয়ে নিয়ে কোন রকম সরসার চালাই। তারপর আবার বড় মেয়ের অসুখ। বিয়ে হয়না। ছোট মেয়ে কেবল আট বছরে পড়েছে। আছিয়া তার বড় বোঝা। তালাক নিয়ে এসে বাপের ঘাড়ে উঠেছে।

শশুররা খুব বড়লোক না হলেও অভাব নেই। বিয়ের প্রথম দিন থেকেই কাজ না করা নিয়ে কিসমতের সাথে আছিয়ার ঝগড়া। গাজার নেশাও আছে কিসমতের। এই নিয়ে কিছু বলতে গেলেই মার থেতে হয় আছিয়াকে। দুই বছরের মাথায় এক সকালে আশপাশের লোক ডেকে আছিয়াকে তালা দেয় কিসমত।

দুই.
বিয়ের রাতে ঘরে ঢুকলো মুজিবর। এটাই তাদের প্রথম দেখা না। একই গ্রামে বাড়ী হওয়ার প্রত্যেক সপ্তাহে হাটে যাওয়ার সময় কিসমতদের বাড়ী হয়ে যেত মুজিবর। আছিয়াও মুজিবরের সাথে বেশ গল্পসল্প করত। কিসমতকে একটু বুঝাইতে অনুরোধ করত আছিয়া।

– আছিয়া, দেইখছিস কিসমত হারামজাদাডা আমার বাসর সাজাতি দেলো না। জীবনে প্রথম বিয়া করলাম। আর কি বয়স আছে যে পরের বার বিয়া কইরা বাসর সাজামু…আসো দেহি তুমারে কিরাম লাগতিছে।
– নানাজান ফাজলামি কইরেন না, মন মিজাজ বালো নেই।
-আইচ্ছা, তুমি তালি ঘুমাই পরো। আইজ আবার গরম পইড়তাছে।

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো আছিয়ার। চোখ খুলে যা দেখলো তাতে যেন আকাশ থেকে পড়লো। মুজিবর ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে পলকহীন তার দিয়ে তাকিয়ে আছে। মায়াভরা চোখ দিয়ে কেবলই পানি ঝরছে। একহাতে তাল পাখা। বিরতিহীনভাবে বাতাশ করছে আছিয়াকে।

তিন.
(বিয়ের এক সপ্তাহ পর)
-কী ব্যাপার নানাজান, আপনি ঘুমাননি?
-না,তুই ঘুমা। বাতাশ দিই।
-বাতাশ লাগবেনা আপনি ঘুমাইয়া পড়েন। সকালে কিসমত আসবে আপনারে নিয়া কোনহানে যেন যাবে।

শুয়ে পড়লো মুজিবর। তবে আছিয়া বুঝতে পারলো সে না ঘুমিয়ে কাঁদছে। ঘন্টা খানেক পর আস্তে করে ডাকলো
-নানাজান…
-ক আছিয়া, শুনতেছি।
-আপনার জীবনের পণ ভাইঙ্গা দিলাম। আমাগোর জন্যি আপনার এই ঘইটলো। মাফ কইরা দিয়েন।

(অনেক্ষন কোন সাড়া দিলো না মুজিবর)।
-আছিয়া একখান কথা কমু? রাগ করবি না তো?
-না করমুনা, কন
-হাফিজুর হুজুর যহন বিয়া পড়াতেছিলো আমার মনে হইছিল আসর থেইকা উইঠা পড়ি। কষ্ট কইরা উথাল-পাথাল যৌবন পার কইরাছি। তবু বিয়া কইরবনা বইলা নিজেরে ভুলাই রাখছি। শেষ কালে আইসা…। তোর জন্যি বড্ড মায়া অইল। তাই আর যাতি পারলাম না। তুই আমার একখান কথা রাখবি?
-কন, চেষ্টা কইব রাখনের
-আমার ক্যান যেন মনে অইতেছে মইরা যাবো। সারা জীবন এই গরখানে একলাই থাইকছি। তু যে কয়ডা দিন থায়িস আমারে…(কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে)…স্বামীর মতই দেহিস। বুড়া বয়াসের ভিমরতি ভাবিসনারে।
আছিয়া কোন কথা বললনা।

চার.
প্রায় এক সপ্তাহ হলো কিসমত মুজিবরের বাড়ীতে আসেনা। শহরে গেছে কাজের খোজে। এবার আর কোন ভাবে সে হারাতে চাইনা আছিয়াকে। মুজিবরের পাটের ব্যবসাও বেশ ভালো চলছে। কিসমতকে বহুবার বলছে তার সাথে কাজে নামতে। কিন্তু পাটের ব্যবসা তার একদমই পছন্দ না। শহরে ইট-খোয়া ভাঙবে সেও ভালো।

দুই মাস কেটে গেলো আছিয়া মুজিবরের সংসার।

আছিয়ার স্বাস্থ্য আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। মুজিবরকে সে আর নানা ডাকে না। কিছু বলেই সম্বোধন করেনা। সারাদিন বাড়ীর কাজ-কর্ম করে। আঙিনা ভরে শাক-সবজি লাগিয়েছে। নতুন গাভীর দুধ হচ্ছে। সকালে বের হয়ে যায় মুজিবর। আসে জোহরের আযানের সময়। দুজন মিলে দুপুরের খাওয়া খায়। তারপর উচু ডুয়ার বারান্দায় বসে পান খায়। গল্প করে। এর মধ্যে হাফিজুর মোল্লা কয়েকবার এসেছে খোঁজ নিতে। তার আচার ব্যবহার আছিয়ার ভালো লাগেনি। সে সোজা মুজিবরকে বলেছে, হাফিজ যেন আর না আসে। চার মাস হইয়া গেলে তাকে ডাইকা সব মিটমাট করা হবে।
-আছিয়া, আইজ বিকালে হাট থেইকা একটা হাস কিনে আনমু। তুই চিতাই চিঠা বানাইস। চুলার পিঠে বইসা হাসের গোশত দিয়া গরম গরম পিঠা খাইমু। কিসমতরে খবর দিমুনি।
-আইচ্ছা। তই কিসমতরে কিছু কইতে হবেনা। আপনার জইন্যে হাসের ডিম বসাইছিলাম। বাচ্চা ফুইটছে। বড় হইলে জবাই কইরা খাইয়েন। পাশের বাড়ীর শিউলিরে কইয়া যাইমুনি দেইখা রাখতে। খালে পানি আইসলে আর সমস্যা অইবনা।
-তুই বুঝলি ক্যামনে আমি হাসের গোশত পছন্দ করি?
-এতো কতা জিগান ক্যান?

আছিয়া বাড়ীতে একা থাকায় রাতে একটু আগেই বাড়ী ফেরে মুজিবর। আজ আরো একটু আগে ফিরলো। হারিকেনের আলো কমিয়ে রেখে চুপচাপ শুইয়ে আছে আছিয়া। বুঝতে পারলো মুজিবর তার পাশে এসে বসেছে।
-আছিয়া ঘুমাইছিস?
-না। বারেন্দায় ঘটিতে পানি আছে। হাত মুখ ধুইয়া নামাজ পইড়া লন। আমি আপনের খানা দিতেছি।
-তোর জইন্যে আকখান জিনিস আইনছি। ক তো দেহি কী?
-কী আর, মির্জপুর হাটের বাতাশা।
-না। পারোস নাই। আগের মাসেও তোর জইন্যে প্রাত্থম হাইট থেইকা এইরাম একখান জিনিস আনছিলাম। তোর খুব পছন্দ অইছিলো। এইডা আরো পছন্দ অইব।
-ঘুম আইতেছে। কী আনছেন তাড়াতাড়ি কন। কাজ সাইরা ঘুমাইতে যামু।
-ঠিক আছে যা। দেহন লাগবো না।

আছিয়াও কোন কথা বললো না। খাওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে চোখ মেলে যা দেখল তাতে ভয়, লজ্জা নাকি রাগ করবে বুঝে উঠতে পারলোনা। গায়ে তার সবুজ রঙের শাড়ী। রেশমের উপর পাকা রং। ঘুমের মধ্যেই কেউ তাকে পরিয়ে দিয়েছে। আর সেটি মুজিবর ছাড়া আর কেউই হওয়ার সম্ভাবনা নাই। সোজা বারান্দায় এসে দাড়ালো আছিয়া। উঠানে পাটের গোছা মেলছিলো মুজিবর। তাকে দেখেও না দেখার ভান করলো। একটু পর বলল-
-আরে কিডা দেহি! এদিকে আয়
-আপনে এইডা ঠিক করেননাই (রাগে গদগদ করতে করতে আছিয়া বলল)।
-এই দিকে আয়, তোরে একখান জিনিস দেহায়। পরে রাগ করোস। ওই যে পিয়ারা গাছটার দিকে চাইয়া দ্যাখ। কয়দিন থেক্যা দেখতাছি বুনো টিয়া পাখিডা পেয়ারা খাইতে আসে। লাল ঠোট আর সবুজ রং দিয়া কি সুন্দর কইরা আল্লাহ তারে বানাইছে। ওইডা দেইখ্যা তোরে এই শাড়ীডা কিইনা দিলাম। তই তোরে বুনো টিয়া না, এক্কেবারে বড়লোকের বাড়ীর আদইরে টিয়ার মতন লাইগতাছে।

আছিয়া কোন কথা বলতে পারলোনা। কিছু একটা বলতে যেয়ে থেমে গেলো। দৌড়ে ঘরে চলে গেলো। তারপর ঘর থেকে চিৎকার করে বললো- বেলা দুপুর হইছে, বুড়া এখনো কিছু না খাইয়া বনের টিয়ার সাতে প্রেম কইরতাছে কেন? টিয়া তার শাড়ী বড্ড পছন্দ কইরছে। এহন খাইতে আসলে ভালা হয়। পানতা পইচা যাবে।

পাঁচ.
আর এক সপ্তাহ বাদে চার মাস পূর্ণ হবে আছিয়া মুজিবরের হিল্লা বিয়ে। কিসমত-আছিয়ার দুজনের প্রতি মায়া বেড়েছে। মুজিবর প্রতিদিন একবার হলেও বলে, ‘তোরে বড্ড দরদ করিরে আছিয়া’। আছিয়া চুপ করে থাকে। এদিকে কিসমত এরই মধ্যে আছিয়ার সাথে পুনরায় বিয়ের আয়োজন শেষ করেছে।

চার মাস পূর্ণ হওয়ার আগের দিন সব গোছগাছ করছে আছিয়া। মুজিবর উঠানে অন্যমনষ্ক হয়ে হাসুয়াতে ধার দিচ্ছে। হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠলো মুজিবর। হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে। ছুটে এলা আছিয়া। ওরে আল্লারে বইলা কাটা আঙুল চিপে ধরল। উঠানের কোনে থাকা গাঁদা ফুলের পাতা চটকিয়ে লাগিয়ে দিলো কাটা জায়গায়। তবু রক্ত বন্ধ হয়না। ঘন্টা খানেক পর বন্ধ হলো। হাতের ব্যাথায় সন্ধ্যায় জ্বর চলে এলো মুজিবরের।
-আপনের কি বেশি খারাপ লাইগতেছে? কিছু খাইবেন?
-রুচি হইতেছেনা আছিয়া
-বিকালে ক্ষেত থেইকা করলা তুলে রাখছি। আলু দিয়া ভাইজা দিই? তিতা খাইলে রুচি আইবো।

খাওয়া শেষে শুতে গেলো আছিয়া। ঘুমের মধ্যে কাতরাচ্ছে মুজিবর। আছিয়ার ঘুম আসছেনা। মুজিবরের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। নিজের সাথে কথা বলছে আছিয়া। ‘এই মানুষটা আমারে বড় মায়া করে। মায়া ভরা মুখ করে বলে, ‘তোরে বড় দরদ করিরে আছিয়া’। আছিয়ার বুক ভেঙে কান্না আসে। কী দরকার ছিলো চিরকুমার থাকার পণ করা এই মানুষটাকে নিয়ে খেলা করার। শেষ জীবনে সাজানো বিয়ে দিয়ে সংসারের নামের নতুন হাল ধরানোর? আছিয়া চলে গেলে হাসের বাচ্চাগুলো কে দেখবে? বড় হলে জবাই দিয়ে চিতাই পিঠা বানাইয়া কে তাকে হাসের গোশত খাওয়াবে? মুজিবর কি আর কোন দিন ‘মুজিবর নানা’ হয়ে হাটের পথে তাদের বাড়ীতে থামবে?

টিয়া পাখি দেখে এবার কি…নাকি হলদে পাখি দেখে হলুদ শাড়ী নিয়ে আসবে মুজিবর? এসব ভাবতে ভাবতে আছিয়া ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। হঠাৎ তার মনে হয় যুবক কিসমতের জন্য এমন সুখের কান্না তার কোনদিন আসেনি। ‘তাইলে কি আমিও এই মানুষডারে দরদ করি?’

আগামিকালই তো মুজিবর তাকে তালাক দিবে। হাফিজুর হুজুর বলছে তালাক শেষে চার মাস বাপের বাড়ীতে থেকে ইদ্দত পালন করতে হবে। এরপরই আবার কিসমতের সাথে তার বিয়ে। কিসমতই হবে তার বৈধ স্বামী। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আবারো মাথা ঘুরে ওঠে তার।

ভোর বেলায় ঘুম ভেঙে আছিয়াকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে মুজিবর। লাফ দিয়ে উঠে তার চোখে মুখে পানি দেয়। আছিয়া টলতে টলতে উঠে বসে। হঠাৎ দরজার কড়া নড়ে। দরজা খুলে দেখে কিসমত ও তার পেছনে মাওলানা হাফিজুর, আদাবর মোড়ল, কিসমতে নিজের নানা অর্থাত মুজিবরের ভাই সহ গ্রামের লোকজন।
-নানাজান চলেন। আছিয়ারে তালাক দিয়া বাপের বাড়ী চার মাসের ইদ্দত পালনের জইন্যে পাঠাইতে হইবে।।
-দাঁড়া কিসমত, আছিয়ার শরীলডা বালা নাই
-নানা আপনে সবসময় শেষ কালে আইসা প্যাচাল বাধান
-কই সে? চলো আছিয়া। সবাই অপেইক্ষা কইরতাছে

ছয়.
গ্রামের মানুষ জটলা পাকিয়ে গোল হয়ে বসে আছে। সবাই যেন খুব মজা পাচ্ছে। মুজিবর একভাবে চোখের পানি ফেলছে। আত্বীয়-স্বজনরা অবাক হয়ে দেখছে। কিসমতের মা উঠে দাড়িয়ে মুজিবরকে বললো, ‘চাচা আপনি তাড়াতাড়ি তিন তালাক কইয়া ফেলেন। সবাই অপেক্ষা কইতাছে।’ মুজিবর অস্ফুট শব্দ করলো কেবল। কেউ একজন উঠে দাড়িয়ে বললো, ’এই তো মুজিবর মিয়া তিন তালাক বইলা দিছে’। সাথে সাথে অন্যরা হ-হ-হ, করে সাড়া দিলো।

বাপের বাড়ীতে চলে গেলো আছিয়া। আজ রাতই হয়তো তার জীবনের শেষ রাত। অবশেষে সে বুঝতে পেরেছে মুজিবরের দরদ তার শরীরে নতুন একটা কিছুর জন্ম দিয়েছে। বাড়ীতে এসেই তার বাপজানকে সেটি বলে দিয়েছে। বাপ বলেছে, ‘কাল সকালে উঠে যেন তোর মরা মুখ দেখি। না হলে আমিই ব্যবস্থা করব।’

এই শেষ খবরটি মুজিবরকে বলে যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল আছিয়ার। কিন্তু বাইরে খুব ঝড়। মুজিবরের বাড়ীও হেটে যেতে কমপক্ষে এক ঘন্টা লাগবে। ঝড়ো বাতাশে দড়ির উপর দুলছে ভাজ করে রাখা আছিয়ার সবুজ শাড়ী। বিদ্যুৎ চমকালেই চোখে পড়ছে তা। সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ উঠে পড়লো আছিয়া। জড়িয়ে নিলো গায়ে। পা টিপে টিপে বের হলো। ঝড়ের গতিতে হাটতে লাগলো মুজিবরের বাড়ীর দিকে। এদিকে মুজিবরের জ্বর আরো বেড়েছে। অজ্ঞানের মতো পড়ে আছে পেছনের বারান্দায়।
-কে? কে আমার কপালে হাত রাইখলো?
-আপনার বউ। আমি জানি আপনি তিন তালাক বলেননাই। আমারে তালাকও দেননাই।
-তুই আইছোছ ক্যান? সইজনে গাছে হলুদ পাখি বসে, বুনো টিয়া মইরা গেছে। নতুন কেই আইসবে মনে কয়। (জ্বরে আবোল-তাবোল বকে মুজিবর)
-সেই নতুন খবর দেওনের লাইগাই আপনার কাছে আইছি। আপনি বুড়া হইলেও এইডা আপনার আর আমার দুই জনার জন্যিই নতুন।

এমন সময় কাল-বৈশাখী ঝড়ের মত গর্জন করে ঘরে ঢুকলো কিসমত। আছিয়াকে মুজিবরের বাড়ীর দিকে আসতে দেখে একটু বেশিই নেশা করেছে। গাঁজার সাথে কড়া তরল জাতীয় নেশা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বেড়ায় গুজে রাখা ধারালো হাসুয়া হাতে নিলো সে। মজিবরকে আছিয়া নতুন খবর দেওয়ার আগেই ঘটে গেল সব।

শেষ.
ঝড় থেমে গেছে। সকালে আছিয়ার রক্তাক্ত লাশ পাওয়া গেল মুজিবরের ঘরে। বুড়ো মুজিবরেরও গলা কাটা। পাটের গাঁদার উপর অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে কিসমত। কেউ জানলো না, খুন কেবল আছিয়া ও মুজিবরই হয়নি। আরেকজনও হয়েছে। মানুষ হয়ে পৃথিবীতে আসা হলোনা তার। তবে টুনটুনি কিংবা দোয়েল পাখি হয়ে ঠিকই আসবে এই বাড়ীতে। হয়ত উড়ে গিয়ে বসবে উঠানের বরই গাছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *